আমার জীবনের কিছু টুকরো-টুকরো স্মৃতি, আমি এখানে আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাইঃ
১
অনেক দিন আগের কথা, তখন সবে মাত্র আমার প্রথম গান "ও আমার, সোনার ময়না পাখি"... "Kiron" কোম্পানি থেকে গ্রামোফোন রেকর্ড হিসাবে বেরিয়েছে , বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছে। তখনও আমার একটা সাইকেল কেনার মত আর্থিক সঙ্গতি ছিলনা ।
গ্রামেরই এক ভাই, তার আগের দিনই, নতুন একটা সাইকেল কিনেছে। সেই সাইকেলটাই চেয়ে নিয়ে প্রায় ৮ কিমিঃ দূরে লাভপুর বাজারে এসেছি কিছু জরুরি জিনিস কিনতে ।
বাজারের কাজ সেরে ফিরছি , দেখলাম "ফুল্লরা" সিনেমা হলে উত্তমকুমারের "নব-দিগন্ত" ছবির শেষ শো চলছে। ভাবলাম, ছবিটা দেখেই যায় ।
হল থেকে যখন বেরলাম, তখন রাত ৮টা বাজে, সঙ্গে টর্চও নেই । যাইহোক, 'জয়গুরু' বলে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, তার উপর বাকুল গ্রামের পরে ক্যানালের কাছে চুরি-ছিনতাই হয় বলে শুনেছি । অন্যের নতুন সাইকেল নিয়ে এসেছি, পথে চুরি গেলে যে কিনে দেব, সে সাধ্যও আমার নেই ; কেন যে সিনেমা দেখতে গেলাম ? সাইকেল চালাতে চালাতে, এইসব সাত-পাঁচ ভাবছি আর নিজেকে মনে মনে গালাগালি দিচ্ছি ।
এদিকে, কখন যে বাকুল পেরিয়ে ক্যানালের কাছে চলে এসেছি খেয়ালই নেই । হঠাৎই রাস্তার দুদিক থেকে দুজন লোক অন্ধকার ফুঁড়ে এসে সাইকেলের হ্যান্ডেল চেপে ধরল, আমি ভয়ে কে? কে? বলে চিৎকার করে উঠতেই , লোকদুটো যেমন এসেছিল তেমনি ভাবেই আবার অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো। অনমনস্ক ছিলাম বলে, চিৎকারটা একটু জোরেই করে ফেলেছিলাম, ভাবলাম সেইজন্যই হয়ত চোরগুলো ভয় পেয়ে পালাল ।
যাইহোক, আমার তো তখন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মত অবস্থা । বাকি পথটুকু প্রাণপণে সাইকেল চালিয়ে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতে দিতে বাড়ি ফিরে, যার সাইকেল তাকে ফিরিয়ে দিয়ে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম ।
পরের দিন সকালে হাটে গিয়েছি সব্জি কিনতে, দেখি একজন লোক আমায় ডাকছে " দাদা, এদিকে একটু শুনেন", আমার পরিচিত কেউ বলে মনে হলনা। কাছে যেতেই লোকটা বলল "চলেন ওই দোকানে একটু চা খাই।"
লোকটার পিড়াপীড়িতে, অনিচ্ছা সত্তেও গেলাম। লোকটা আমাকে চা দোকানের এক কোনে নিয়ে গিয়ে বসাল এবং দুটো চা এর অর্ডার দিল। তারপর এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে আমাকে ফিসফিস করে বলল "দাদা, কাল রেতের ঘটনার জন্য মাফ কইরা দ্যান, আন্ধারে আপনারে ঠিক ঠাওর করতে পারি নাই, তাই সাইকেল ধরে ফেলায়ছিলাম। আপনি যখন কে কে বলে চেঁচেই উঠলেন, তখন আপনারে চিনতে পারলাম।"
আমি প্রথমে চমকে গেলেও, সামলে নিয়ে বললাম, "না না ঠিক আছে, না বুঝে করে ফেলেছ, জেনে তো আর করনি।কিন্তু তুমি চুরি-ছিনতাই এইসব কাজ কেন কর? সৎ পথে খেটে খেতে পার তো!"
লোকটা বলল "এসব আমি করতে চাইনা দাদা, সঙ্গদোষে এই পথে চলে এয়েছি। তবে আপনার চিন্তা নাই, আপনি এক কাজ করবেন, রেতেরবেলা ওই পথে গেলে, আপনার রেকড এর "ও আমার সোনার ময়না পাখি", ওই গানটো গাইতে গাইতে আসবেন। তাইলে আমরা বুজবো যে বাউল-দাদা আসতেচেন। কেউ আপনারে আটকাবেনা "
বুঝলাম আমার গানই কাল রাতে আমায় বাঁচিয়েছে।
লোকটা বলল "এসব আমি করতে চাইনা দাদা, সঙ্গদোষে এই পথে চলে এয়েছি। তবে আপনার চিন্তা নাই, আপনি এক কাজ করবেন, রেতেরবেলা ওই পথে গেলে, আপনার রেকড এর "ও আমার সোনার ময়না পাখি", ওই গানটো গাইতে গাইতে আসবেন। তাইলে আমরা বুজবো যে বাউল-দাদা আসতেচেন। কেউ আপনারে আটকাবেনা "
বুঝলাম আমার গানই কাল রাতে আমায় বাঁচিয়েছে।
২
তখন সবে আমার একটি রেকর্ড ও দুটি ক্যাসেট বের হয়েছে, বাউল শিল্পী হিসাবে সবে মাত্র একটুআধটু নাম ডাক হয়েছে । একদিন আমার বন্ধু চাঁদগোপাল মুখার্জি এসে বলল, হাটকালুয়া মাদ্রাসায় নজরুল-জয়ন্তীর অনুষ্ঠান হচ্ছে, আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে শিল্পী জোগাড় করার; তোমাকে ওখানে নজরুলগীতি গাইতে যেতে হবে।
আমার সঙ্গীত জীবনের প্রথম দিকে আমি প্রচুর জলসায় নজরুলগীতি গেয়েছি, শ্রোতাদের প্রসংসাও পেয়েছি। তাছাড়া নজরুলের গানের প্রতি আমার চিরকালই একটা দুর্বলতা আছে। আমি তো এক কথায় রাজি, কিন্তু সমস্যা হল ততদিনে 'বাউল' হিসাবে আমার গায়ে অদৃশ্য লেভেল সেঁটে গেছে। তাছাড়া একজন নামী শিল্পী হিসাবে অযাচিত ভাবে একটা স্কুলের অনুষ্ঠানে যেতেও কেমন একটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল।
এদিকে চাঁদগোপালও ছেড়ে দেবার পাত্র নয়, আবার আমারও আন্তরিক ইচ্ছে প্রবল। শেষে, দুজনে শলা পরামর্শ করে ঠিক হল যে, যাবো তবে ছদ্মবেশে । জীবনে সেই প্রথম এবং শেষবার আমি শার্ট-প্যান্ট পড়লাম , তাও আবার নিজের নয়, চাঁদগোপালের । মাথায় একটা ক্যাপ পড়লাম, চোখে একটা ফলস চশমা নিলাম, যাতে কেউ চিনতে না পারে। শিল্পী তালিকায় নাম দেওয়া হল কার্ত্তিক চন্দ্র দাস । ঘটনাচক্রে, এটি আমার পিতৃদত্ত নাম, পরে অবশ্য ভোটার কার্ড থেকে পাসপোর্ট সবেতেই কার্ত্তিক দাস বাউল হয়ে গেছি। আর ঠিক হল যে, আমরা দুজন ছাড়া, এই কথা আর কেউ জানবে না।
নির্দিষ্ট দিনে, জয় গুরু বলে দুজনে রওনা দিলাম। কি রকম একটা অসস্ত্বি হচ্ছিল, কিন্তু মঞ্চে উঠে গান শুরু করতেই সেটা কেটে গেলো। শিল্পী তালিকায় সবার শেষে ছিলাম আমি। একটার পর একটা গান গেয়ে চলেছি আর সঙ্গে তুমুল হাততালি। রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ গানটাতো শ্রোতাদের অনুরোধে দুইবার গাইতে হল। কখন যে ঘণ্টা দেড়েক কেটে গেছে বুঝতেই পারিনি।
অনুষ্ঠান তো ভালয় ভালয় শেষ হল, কিন্তু বিপদ হল জলখাবার নেওয়ার সময়। যে ছেলেটি জলখাবারের প্যাকেট দিচ্ছিল সে বলল "আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো, খুব চেনা চেনা লাগছে। আপনার বাড়ি কোথায়?" বললাম "ধনডাঙ্গা।" সে বলল "হ্যাঁ, মনে পড়েছে । আপনি বিধান কে বাউল গান শেখাতে আসেন, আপনি তো কার্ত্তিক দাস বাউল।" বললাম "চুপ চুপ।" আর চুপ, ততোক্ষণে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। আশেপাশের সবাই আমাকে ঘিরে ধরেছে , ছাত্র ছাত্রী থেকে মাস্টারমশাই সবাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। হেড মাস্টারমশাই এসে আমকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে অফিস ঘরে বসালেন। চারিদিকে স্কুল কমিটি আর শিক্ষকদের ভিড়।
হাটকালুয়ায় বিধান চন্দ্র দাস নামে আমার এক ছাত্র আছে, সেখানে আমি মাঝে মাঝে গান শেখাতে যেতাম ।
ওই ছেলেটি আমাকে সেখানেই কয়েকবার দেখেছে। ছদ্দবেশে ছিলাম বলে দূর থেকে দেখে কিছু বুঝতে পারেনি।
কিন্তু গান গাওয়া শুরু করতেই, আমার গলা শুনে ওর সন্দেহ হয়, পরে আমার বাড়ি কোথায় জানতে চায়, একেবারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য।
হেড মাস্টারমশায় বললেন " আপনার মত শিল্পীকে আমাদের মধ্যে পেয়েছি, এ তো আমাদের সৌভাগ্য । কিন্তু আপনি পরিচয় গোপন করতে গেলেন কেন?" যদিও আপনি নজরুলগীতিও দুর্দান্ত গেয়েছেন, কিন্তু যে বাউল গানের জন্য আপনার এত নামডাক সেটাই তো শোনা হলনা।" পরে কোনও অনুষ্ঠানে এসে বাউল গান গাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, তবে সেদিন স্কুল থেকে ছাড়া পেয়েছিলাম।
৩
আকাশবাণী কলকাতা থেকে রেকর্ডিং সেরে বাড়ি ফিরছি, রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম । বাস থেকে নেমে কোনও রকমে ছুটে এসে হাওড়ায় "বিশ্বভারতী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার" এর একটা কামরায় উঠে পড়লাম। উঠে দেখি, কোনও সিট ফাঁকা নেই। কলকাতা থেকে এক দল ছেলে-মেয়ে তারাপীঠে যাচ্ছে বেড়াতে। তারা নিজেদের মধ্যে তুমুল হই-হট্টগোল আর ইয়ার্কি-ফাজলামিতে মত্ত, কারন-সুধার তীব্র গন্ধও! নাকে এলো।
একটা সিটে দেখলাম একটু চেপে বসলে আমার একটু জায়গা হতে পারে। একটা ছেলেকে একটু চেপে বসার অনুরোধ করতেই, ঝাঁঝিঁয়ে উঠলো "কেন চেপে বসব? রীতিমতো টিকিট কেটে ট্রেনে উঠেছি", অগত্যা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হকারদের গুঁতোগুঁতি খেতেখেতে আসছি।
আমার পোশাক বলতে গেরুয়া পাজামা-পাঞ্জাবি, কাঁধে দোতারা ঝোলানো ; অন্য কাঁধে কাপড়ের একটি ঝোলার মধ্যে গাব-গুবি ও অন্যান্য দরকারি জিনিসপত্র। ট্রেন ব্যান্ডেল ছাড়ার পর অন্য সিটে বসা একটা ছেলে বলল "পোশাক দেখেতো মনে হচ্ছে তুমি বাউল গান কর, বাড়ি কোথায়?"; বললাম "বীরভূম"।
সে অন্যদেরকে শুনিয়ে বলল "এই শোন, বীরভূমের বাউল পেয়েছি, গান শুনবো, তোরা একটু চুপ কর।" তারপর আমার দিকে ফিরে বলল "নাও ভাই, একটা ভালো দেখে গান ধরোতো, চিন্তা নাই বিনা পয়সায় শুনবনা, তোমায় ৫০ টাকা দেব।" আমি বললাম "না ভাই, বহু কাল খালি গলায় গান গাওয়ার অভ্যেস নেই।" সে বলল "বেশ ঠিক আছে ১০০ টাকা দেব, খুশি?" বললাম "না।" ততোক্ষণে ওই দলেরই একজন "ভোলা মন আমার" বলে তান ধরে নিয়েছে। আমার কথা শুনে কেউ একজন ফোঁড়ন কাটল "ওরে এ তো বামা-তবলা ছাড়া গান গাইতে পারেনা।" অন্য একজন, ব্যাঙ্গের ছলে জিজ্ঞাসা করল "তা তোমার নামটি কি ভাই, বাউল পোশাক পরে আছ, কাঁধে দোতারা নিয়ে ঘুরছ অথচ গান গাইবেনা বলছ? তা কোথায় গান করতে গিয়েছিলে আকাশবাণী? নাকি দূরদর্শনে?" বললাম "আমার নাম কার্ত্তিক দাস বাউল, আর হ্যাঁ তুমি ঠিকই বলেছ, আকাশবাণীতেই গিয়েছিলাম। আর এই যে রেকর্ডিং এর চিঠি, আশা করি পড়ে বোঝার মত লেখাপড়া তুমি জানো"।
নিমেষের মধ্যে ছেলেগুলির বাচালতা থেমে গেলো। পাশের সিট থেকে উঠে এসে, একটা ছেলে ভালো করে আমাকে দেখে নিয়ে বলল "আপনার ক্যাসেট আছে, দূরদর্শনে গান করেন দেখেছি" বললাম "হ্যাঁ, কিন্তু যেসব বাউলদের ক্যাসেট নেই, তারা কি মানুষ নয়? জেনে রাখ, বাউলরা গান করে মানুষকে আনন্দ দেওয়ার জন্য, টাকা রোজগার করে ধনী হওয়ার জন্য নয়"।
অন্য একটি ছেলে উঠে এসে বলল " আসুন কাকু, আমাদের সিটে এসে বসুন, আসলে আপনাকে যতবার দেখেছি পাগড়ী বাঁধা অবস্থায় দেখেছি তো, তাই ঠিক চিনতে পারি নাই।" আমি বললাম "সে ঠিক আছে, কিন্তু কেউ গান করতে না চাইলে, তোমরা তাকে ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ করবে?" সে বলল "আমার সব বন্ধুদের পক্ষ থেকে আমি আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।" ঠিক সেই সময় একজন চা-ওয়ালা যাচ্ছিল, ছেলেটি বলল "নিন কাকু, চা খান।" আমি বললাম "না, তোমরা খাও।" ছেলেটি বলল "যদি চা না খান, তবে জানবো যে আপনি এখনো আমাদের ক্ষমা করেননি।" ফলে বাধ্য হয়েই চা খেতে হল। সেদিন ট্রেন থেকে নামার আগে একগাদা অটোগ্রাফ আর ভিজিটিং কার্ড বিলি করে তবে ছাড়া পেয়েছিলাম।