আমার-কথা

কিভাবে সঙ্গীত জগতে এলাম :

বীরভূম জেলার লাভপুর থানার অন্তর্গত 'ধনডাঙ্গা' গ্রামে একটি নিম্নবিত্ত তপশীলি জাতিভুক্ত পরিবারে আমার জন্ম । আমার বাবা শ্রীকুমারিশ দাস দাঁড়কা গ্রামের কবিয়াল শ্রীকাশিনাথ কোনাই এর দলে 'দোহার' করতেন । সঙ্গীত এর সঙ্গে আমার পারিবারিক যোগাযোগ বলতে ছিল এটুকুই ।

খুব ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীত আমাকে চুম্বকের মত টানতো। আমাদের বাড়ির পাশেই একটি বিত্তশালী পরিবারের বাস ছিল, সেই বাড়ির একটি ছেলেকে গ্রামেরই শ্রীপরবব্রহ্ম মিশ্র রোজ সন্ধ্যাবেলা গান শেখাতে আসতেন। তখন আমি ৩য় শ্রেণীতে পড়ি , পাশের বাড়ির ছেলেটি হারমোনিয়াম নিয়ে গান শুরু করলেই, পড়া ফেলে আমিও পিছনের দরজা দিয়ে দে ছুট ...  সোজা যে ঘরে ছেলেটি গান করতো, সেই ঘরে গিয়ে হাজির হতাম। সে সময়ে বাড়িতে হারমোনিয়াম, গ্রামোফোন বা রেডিও থাকাটা ছিল, বিরাট বনেদিয়ানা বা গর্বের  ব্যাপার। নিজের হারমোনিয়াম নিয়ে ওই ছেলেটিরও বেশ অহঙ্কার ছিল, কতবার যে তার হারমোনিয়ামে হাত দিয়ে অপমানিত হয়েছি... তবু যেতাম, কারন ওই 'সঙ্গীত' নামক চুম্বকের টান অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা আমার ছিলনা ।

আবার সেই একই টানে রোজ দুপুরে যেতাম গ্রামেরই শ্রীশান্তি মিশ্রর বৈঠকখানায় । ওনার বসার ঘরে, একটা বিরাট বড় কাঠের রেডিও ছিল, গ্রামের অনেক লোকজন সেখানে গান শুনতে আসতো । ছোটদের ভিতরে প্রবেশাধিকার ছিলনা, আমি ও আমার এক বন্ধু, তাই জানালার বাইরে রড ধরে দাঁড়িয়ে থাকতাম আর ভাবতাম রেডিওর ভিতরে যে লোকগুলো গান করে, তারা কখন বেরিয়ে আসবে।  আমার এই কৌতূহলের ব্যাপারটা বড়রাও জানতো, অনেক সময় এই নিয়ে তারা মজাও করতো। কোনও দিন হয়ত বলত " কার্ত্তিক, আর একটু আগে আসতে পারলি না? এইমাত্র লোকগুলো খাওয়া-দাওয়া ক'রে, আবার রেডিওর ভিতর ঢুকে গেলো, কাল একটু সকাল-সকাল আসিস" ।

সেই ছেলেটির কথায় ফিরে আসি......৬ মাস ধরে রোজই দেখতাম ছেলেটি, একটাই গান তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে "ওগো ভগবান.........করো মোরে দান",  শুনে শুনে আমার তো পুরো গানটাই মুখস্থ হয়ে গেলো । মাঠে  ঘাটে ঘুরে বেড়াই আর নিজের মনে গলা ছেড়ে ওই গানটাই গাই। এমনি একদিন পুকুরপাড়ে বসে, মনের সুখে গানটা গাইছিলাম, পরববাবু সেই সময়, ওইদিক দিয়েই কোনও কাজে যাচ্ছিলেন । আমার গান শুনে, তিনি আমাকে কিছু না বলে বাবাকে ডেকে বললেন "শোন কুমারিশ, তোর ছেলের গলায় সুর আছে, ওর গান হবে। তুই একটা হারমোনিয়াম কেনার ব্যাবস্থা কর, আমি ওকে বিনা পারিশ্রমিকে গান শেখাব।"  বাবা বলল "আর একটু বড় হোক, একটু লেখাপড়া শিখুক, তারপর না হয় গান শিখবে।"  মাস্টারমশাই বললেন " আমার কাছে যারা গান শেখে, তারা কি সব লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে? গানও শিখুক সঙ্গে লেখাপড়াও করুক"।

আমাদের মত হত-দরিদ্র পরিবারে তখনকার দিনে, হারমোনিয়াম কিনে শিক্ষক রেখে ছেলেকে গান শেখানোর কথা,
 কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারতো না ।  মাস্টারমশাইয়ের জেদাজেদিতে বাবা নিমরাজি হলেন বটে, কিন্তু নতুন হারমোনিয়াম কিনে দেওয়ার মত আর্থিক অবস্থা তখন বাবার ছিলনা। নাছোড় মাস্টারমশাই কিন্তু দেখা হলেই বাবাকে তাগাদা দেন "কিরে, হারমোনিয়ামের ব্যাবস্থা হল ?" এদিকে, আমি তো আনন্দে আটখানা। পড়াশোনা আমার মোটেই ভালো লাগেনা, সঙ্গীতই আমার প্রান। বাবা আশেপাশের গ্রামে, পুরানো হারমোনিয়ামের খোঁজ করতে শুরু করলেন ।
একদিন খবর পাওয়া গেল, লায়েকপুরের (লাত পুর) হরিনামের দল ভেঙ্গে গিয়েছে, সেই দলের হারমোনিয়ামটা বিক্রি করবে।  বাবা পরদিনই সেই হারমোনিয়ামটা, ৩০ টাকায় কিনে আনলেন। (তখন নতুনের দাম ছিল ১৫০ টাকা)।

হারমোনিয়াম তো এলো, এদিকে দেখা দিল আর এক সমস্যা, পরব মাস্টারমশাই ততদিনে আরও ভালো করে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শেখার জন্য 'লখনউ' চলে গেছেন, কবে ফিরবেন কেউ জানেনা । সেই ছেলেটির দেখে দেখে সা-রে-গা-মা টা আমি নিজেই সাধতে শিখে গিয়েছিলাম, কিন্তু রাগ-রাগিনি কে শেখাবে? আমার তো তখন তীরে এসে তরী ডুবে যাওয়ার মত অবস্থা। গ্রামেই আর একজন ছিলেন শ্রীসুবল চক্রবর্তী, তিনি খুব ভালো আধুনিক গান গাইতেন, গলাটিও ছিল চমৎকার । কিন্তু পরববাবুর মত গান তাঁর পেশা ছিলনা, তিনি পেশায় ছিলেন পুরোহিত।

অগত্যা বাবা তাঁকেই গিয়ে ধরলেন । তিনি বললেন "উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত তো আমি খুব একটা জানি না, দু-চারটে রাগ হয়ত শেখাতে পারবো, তারপর কিন্তু অন্য মাস্টার দেখতে হবে।" বাবা বলল "সে পরে যা হয় হবে, কার্ত্তিকের গানের হাতে খড়িটা তো দিয়ে দেন।" আগেই বলেছি তিনি পেশায় ছিলেন পুরোহিত, তিথি-নক্ষত্র, আচার-বিচার এ সব খুব মানতেন, দিলেন এক খানা লম্বা ফর্দ করে, আর পাঁজি দেখে দিনক্ষণ ঠিক করলেন, সঙ্গীত-দীক্ষা দেওয়ার ।

নির্দিষ্ট দিনে, ২ ঘণ্টা ধরে যাগযজ্ঞ ও পূজা করার পর তিনি আমার কানে মন্ত্র দিলেন। বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা, কানে মন্ত্র যাওয়া মাত্র, আমার মনে হল যেন, চোখের সামনে গানের স্বারলিপি গুলো দেখতে পাচ্ছি। এই ভাবে শুরু হল আমার সঙ্গীত জীবন। ওনার কাছে কিছুদিন বিভিন্ন রাগ-রাগিনি শিখলাম, কিছু আধুনিক ও শ্যামাসংগীতও শিখলাম। ইতিমধ্যে পরব মাস্টারমশাই লখনউ থেকে ফিরে এলেন, শুরু হল আমার সঙ্গীত জীবনের ২য় অধ্যায়। তাঁর কাছে  শাস্ত্রীয়সঙ্গীত ও নজরুলগীতি শিখতে লাগলাম।

একদিন সুবলকাকা বললেন "সর্পলেহনা থেকে আমার ভগ্নিপতি এসেছে, সন্ধ্যাবেলা একবার আমার বাড়িতে যাস, তোর গান শুনবে।" তো গেলাম সন্ধ্যাবেলা...গানও শোনালাম । গান শোনার পর ভদ্রলোক বললেন "বাঃ তুমি তো বেশ ভালই গান গাও !  আমরা সামনের পুজার সময় যাত্রাপালা করছি,  তুমি যেও যাত্রাপালার মাঝে দুএকটা গান গেয়ে শোনাবে।" যদি শ্রোতাদেরই না শোনাতে পারলাম, তবে আর গান শিখে লাভ কি ? সুতরাং আমি এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। নির্দিষ্ট দিনে পৌঁছে গেলাম সর্পলেহনা, যাত্রার এক একটি  দৃশ্যের শেষে, পাত্র-পাত্রীদের পোশাক পরিবর্তনের সময়টুকুতে আমি একটি বা দুটি করে গান গাইতে লাগলাম। প্রচুর প্রশংসা, তুমুল হাততালি আর সেই সঙ্গে পুরস্কার হিসাবে ১, ২,  বা ৫ টাকার নোট শ্রোতারা জামায় গেঁথে দিতে থাকলেন। একজন শিল্পীর কাছে শ্রোতাদের হাততালি আর প্রসংসার চেয়ে মুল্যবান আর কিছুই নেই। আবার আর একদিকে, এর চেয়ে বড় নেশাও কিছুই নেই। আমাকেও ওই নেশাতেই পেয়ে বসল।


ক্রমশ্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌

কি ভাবে 'বাউল' হলাম :